গরীবের বন্ধু কমিউনিটি রেডিও
প্রতিক্ষণ ডেস্কঃ
কমিউনিটি রেডিও। বর্তমানে বাংলাদেশের গরীব জনগোষ্ঠীর কাছে তাদের উন্নয়নের সহায়ক হিসেবে এ এক অতি পরিচিত নাম। বর্তমান এই তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির যুগে পৃথিবীর সকল দেশের মতো আমাদের দেশেও এক শ্রেনীর সুবিধাভোগী মানুষ যখন ইন্টারনেট, স্যাটেলাইট প্রভৃতি উন্নততর যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবহার করে দেশ, নগর ও শহরের সীমানা ভেঙ্গে ফেলছে; তখন আরেক শ্রেনীর দরিদ্র মানুষের এসব আধুনিক বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের কাছে পৌঁছানো তো দূরের কথা; নেই টেলিভিশন, রেডিও বা সংবাদপত্রের কাছে পৌঁছানোর সুযোগও। তথ্য ও সংবাদের অভাবে এই মানুষগুলো কোনদিনই উন্নয়নের স্বপ্ন দেখতে পারে না। এমন অবস্থায়, এই দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কাছে ঠিক তাদের বোধগম্য ভাষায় তথ্য সরবরাহ নিশ্চিত করে তাদের অর্থনৈতিক, সামাজিক, আচরণগত তথা জীবনযাত্রার সার্বিক মান উন্নয়নে কমিউনিটি রেডিও রাখে অসাধারণ ভূমিকা।
কমিউনিটি রেডিও হচ্ছে কমিউনিটি ভিত্তিক রেডিও। এখানে সাধারণভাবে সীমিত প্রযুক্তিগত স্থাপনার মাধ্যমে অল্পসংখ্যক মানুষ কাজ করে এবং সীমিত এলাকা জুড়ে এর অনুষ্ঠান সম্প্রচারিত হয়।
বাংলাদেশে কমিউনিটি রেডিওর ইতিহাস ঘাটতে গেলে দেখা যায়, ২০০৮ সালের ১২ মার্চ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তথ্য মন্ত্রনালয় বাংলাদেশে কমিউনিটি রেডিও স্থাপন, সম্প্রচার ও পরিচালনা নীতিমালা ঘোষণা করে। আর এই নীতিমালার আলোকে তথ্য মন্ত্রণালয় একটি তথ্য বিবরণীর মাধ্যমে ২০১০ সালের ২২ এপ্রিলে প্রথম বারের মতো মোট ১৪ টি কমিউনিটি রেডিও চালু করার কথা ঘোষণা করে। অবশ্য বাংলাদেশ অনেকটা দেরি করে ফেললেও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে কমিউনিটি রেডিওর ইতিহাস কিন্তু সুপ্রাচীন, প্রায় অর্ধশতাব্দী পুরনো। দারিদ্র্য ও সামাজিক অনাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে ১৯৪৮ সালে ল্যাটিন আমেরিকার বলিভিয়ায় প্রতিষ্ঠিত “মাইনার্স রেডিও” এবং একই বছরে কলম্বিয়ায় প্রতিষ্ঠিত “রেডিও সুতাতেনজা” কমিউনিটি রেডিওর মাধ্যমে বিশ্বে কমিউনিটি রেডিও ব্যবস্থার সূত্রপাত হয়।
আমাদের দেশ ধীরে ধীরে উন্নয়নের পথে এগিয়ে গেলেও দেশের জনগনের বিরাট একটি অংশ এখনো উন্নয়নের ছোঁয়া হতে বঞ্চিত। আর একথা সবাই স্বীকার করেন যে, গণমাধ্যম সবসময়ই উন্নয়নের বিরাট একটি প্রভাবক হিসেবে বিবেচিত হয়। তবে প্রচলিত গণমাধ্যমসমূহ যেমন সংবাদপত্র, রেডিও, টেলিভিশন ইত্যাদিতে সমাজের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী ব্যক্তিবর্গের আদর্শই বেশি প্রচারিত হয়, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী সেখানে প্রবেশাধিকার পায় না। কমিউনিটি রেডিও এই ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। কমিউনিটি রেডিও গঠিতই হয় প্রান্তিক পর্যায়ে বসবাসরত জনগনের জন্য এবং এই রেডিও সেই জনগন দ্বারা এবং জনগনের মালিকানাতেই পরিচালিত হয়। তাই কমিউনিটি রেডিও প্রান্তিক জনগোষ্টীর উন্নয়নে রাখে এক শক্তিশালী ভূমিকা।
গ্রামীন দরিদ্র মানুষ তথ্য ও যোগাযোগের অপ্রতুলতার কারণে নিজেদের বিচ্ছিন্ন ভাবে এবং তাদের চিন্তাভাবনাও পরষ্পর বিচ্ছিন্ন বলে তারা উন্নয়নে অবদান রাখতে পারে না। এ কথা শুধু গ্রামীন ব্যক্তিদের জন্যই নয় বরং সকল দরিদ্র ব্যক্তির জন্যই প্রযোজ্য। আর কমিউনিটি রেডিও গ্রামীণ, সুবিধাবঞ্চিত মানুষের মনে অংশগ্রহণের অনুভূতি জাগায় যা তাদেরকে উন্নয়ন কর্মকান্ডে অংশ নিতে উদ্বুদ্ধ করে।
বাংলাদেশে বর্তমানে ১৪টি কমিউনিটি রেডিও তাদের কার্যক্রম চালিয়ে চালিয়ে যাচ্ছে। এরা হলো রেডিও সাগরগিরি, রেডিও নলতা, রেডিও মুক্তি, রেডিও পল্লীকন্ঠ, রেডিও বরেন্দ্র কমিউনিটি, রেডিও মহানন্দা, রেডিও পদ্মা, রেডিও ঝিঁনুক, রেডিও বিক্রমপুর, রেডিও লোকবেতার, রেডিও চিলমারি, রেডিও সুন্দরবন, রেডিও নাফ, কৃষি রেডিও। এদের প্রত্যেকটিই চরম দারিদ্র্য ও ক্ষুধা নির্মূল, শিশু মৃত্যুহার হ্রাস, জেন্ডার সমতা আনয়ন ও নারীর ক্ষমতায়ন, সার্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা অর্জনের মতো বিষয়গুলোর উপর গুরত্ব দিয়ে অনুষ্ঠান প্রচার করে চলেছ। প্রাকৃতিক দূর্যোগের সময় কমিউনিটি রেডিওগুলো পালন করে তাৎপর্যপূর্ন ভূমিকা। এছাড়া মৎস্যজীবি, কৃষিজীবি প্রভৃতি প্রান্তিক শ্রেনীর মানুষকে সচেতন করে তোলা এবং তাদের জীবনমান উন্নয়নে চমকপ্রদ ভূমিকা রেখে চলে বাংলাদেশের কমিউনিটি রেডিওসমূহ।
দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর উন্নয়নের জন্য এত গুরুত্বপূর্ণ যে কমিউনিটি রেডিও তার সংখ্যা বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে আরো বাড়ানো প্রয়োজন। এছাড়া কমিউনিটি রেডিওতে যাতে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রতি সহানুভূতিশীল এবং দক্ষ কর্মী নিয়োগ পায় সেদিকেও লক্ষ্য রাখা দরকার। তবে সবচেয়ে বেশি দরকার কমিউনিটি রেডিওগুলোতে দরিদ্র ব্যক্তিদের সংশ্লিষ্টতা বাড়ানোর দিকে লক্ষ্য রাখা কারন এই কমিউনিটি রেডিওর সৃষ্টি তো আসলে তাদের উন্নয়নের স্বপ্ন বুকে নিয়েই হয়েছে।
প্রতিক্ষণ/এডি/সাদিয়া